শনিবার, ১৩ এপ্রিল, ২০২৪

মাতৃত্বের স্বাদ

 


“হ্যালো! মিস বিশ্বাস?” 

অচেনা স্বর, কিন্তু বাঙালি উচ্চারণ। “ইয়েস, ’অ্যাম ডক্টর বিসওয়াস। হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ?”

কোভিড-এর কড়া লকডাউন আলগা হবার পর, প্রায় রোজই দু’তিনটে নতুন ফোনকল পাই। যাদের সত্যিকারের প্রয়োজন, যারা গৃহবন্দি অবস্থায় কোনও সাহায্য পায়নি, তারা এখন তেড়েফুঁড়ে ফোন করে। আবার অনেকে দীর্ঘদিন ঘরে আটকা থেকে বিপর্যস্ত হয়ে করে। এই মহিলা কোন দলে?

“আপনি বাংলা বলেন?” 

আমার ইতিবাচক উত্তর শোনার আগেই ওদিক থেকে তোড়ে কথা ছুটল। 

“আমি দেবত্রীর মা, অনসূয়া দাম। আপনার সঙ্গে দেখা করা অত্যন্ত প্রয়োজন। এখনই আসতে চাই। খুব দরকার। কতগুলো বিশেষ কথা আছে।”

দেবত্রী সরকার আমার পেশেন্ট। কয়েক মাস হল আসছে। তার মা? কিন্তু ‘দরকার’ বললেই ছাড়পত্র দিতে হবে নাকি! দেবত্রী নিজের থেকে আমার কাছে আসেনি— বন্ধু মনোবিজ্ঞানী ডাঃ জুলিয়া প্রেন্টিসের সুপারিশে এসেছে। যবে থেকে প্র্যাকটিস আরম্ভ করেছি, জুলিয়া কিছু কিছু রোগী থেরাপির জন্যে পাঠায়। মানসিক রোগে সাইকায়াট্রিস্টরা ওষুধের প্রেসক্রিপশন লেখে ঠিকই, কিন্তু মনের জট খোলার কাজে লাগতে হয় আমাদের। আবার মানসিক ভারসাম্য মোটামুটি থিতু না হলে থেরাপির কাজ করা যায় না। তার জন্যে লাগে ওষুধ। অর্থাৎ আমরা দু’জনেই দু’জনের পরিপূরক। জানি না চিনি না, এক মহিলা ‘কথা আছে’ বললে তো চলবে না… ওঁর মেয়ে যে আমার পেশেন্ট তাও স্বীকার করতে পারি না। গোপনীয়তা রক্ষার দায়িত্ব আছে আমার!

দেবত্রীকে যখন ওর স্বামী জুলিয়ার কাছে নিয়ে গেছিল তখন মেয়েটার বেশ ম্যানিক অবস্থা। মিষ্টি চেহারার ঝকঝকে মেয়ে, চোখেমুখে কথা বলছে— কথার গতিতে মেশিনগানের স্পিড। একই সঙ্গে হাত-পায়ে উইন্ডমিল চলছে। পরে শুনেছি অভিবাসী বাঙালি সমাজে দেবত্রীর বর্ণনা – প্রাণোচ্ছল, চঞ্চল, আড্ডাবাজ। একটু বেশি বকবক করে ঠিকই, কিন্তু কী পরোপকারী, হাসিখুশি! আর সুন্দর মুখের জয় তো সর্বত্র হবেই। সবার মুখে একটা বিশেষণ বারবার ঘুরেছে – প্রাণবন্ত! 

দেবত্রী এদেশে এসেছিল নিউ জার্সির এক বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়নের স্নাতকোত্তর ছাত্রী হয়ে। পড়াশোনায় যথেষ্ট ভালো না হলে হুট করে বৃত্তি পেয়ে কেউ বিদেশ আসতে পারে না – বিশেষ করে আজকের দিনে। আসার কিছুদিনের মধ্যেই মেয়েটা ইউনিভার্সিটির ফরেন স্টুডেন্টস্‌ গ্রুপে একটা সাংস্কৃতিক ফাংশান লাগিয়ে দিল। রবীন্দ্রসংগীত, গীতিনাট্য আর প্রধান অতিথির গলায় মালা-চাদর। দর্শক অভ্যর্থনা করা হল চন্দনের টিপ আর গোলাপজলের ঝারি দিয়ে – সে এক মনোহরা উৎসব। একটা মেয়ে, দ্বিধা-দ্বন্দ্বহীন, এদিক ওদিক ছুটোছুটি করে জোগাড়যন্ত্র করছে, সহকারীদের মিষ্টি বকুনি দিচ্ছে! সকলেই মুগ্ধ! সেই আসরেই এই অনন্য মেয়েটার প্রেমে পড়ে গেল অভিবাসী সমাজের দীপ্যমান স্কলার প্রদীপ্ত দে। সে গল্প আমি প্রদীপ্তর কাছে শুনেছি।

মঙ্গলবার, ৯ এপ্রিল, ২০২৪


 সোউউ… করে একটা অটো চলে গেলো  সিকনের সামনে দিয়ে। সে রাস্তার ধারে বসে আছে। তার মতো একটা ছেলের রাতের বেলা রাস্তার ধারে বসে থাকা আশ্চর্যের ব্যাপার। রাত অবশ্য বেশি হয়নি সবে নয়-টা বাজে। সে যে রাস্তার ধারে মাটিতে বসে আছে তা নয়। সে রাস্তার ধারের একটা মোদি দোকানের বেঞ্চিতে বসে আছে। রাত বেশি না হলেও আশেপাশের সব দোকান বন্ধ। মাঝে মাঝে পাহাড়াদার এসে সব দোকান দেখে যাচ্ছে সিকন বসে অপেক্ষা করছে। কোনো মানুষের জন্যে অপেক্ষা নয়, অপেক্ষা করছে রাত শেষ হওয়ার। রাত শেষ হলেই সে রওনা দেবে। তবে অপেক্ষার মাঝেও সে একটা আনন্দ খুজেঁ পেয়েছে। শীত চলে এসেছে, ঠান্ডার একটা রেশ আছে বাতাসে। একটা দারুন গন্ধ আছে। বাতাসের ঝাপটা যখন মুখে এসে লাগে তখন তার মনে অনেক আনন্দের সৃষ্টি হয়। সে ভাবতে থাকে এই পরিবেশটা যদি এখানেই থেমে যায়। সারাজীবন যদি এমনি থাকে তাহলে মন্দ হয়না। এই আনন্দের মাঝে হঠাৎ তার মনে ভয়ের কালো ছায়া ছড়িয়ে পরে। ভয়টা আসছে রাস্তা দিয়ে চলতে থাকা সাদা আলখাল্লা পরা লোকটা থেকে। তার এখন মনে পরছে ছোট বেলায় শোনা একটা কাহিনীর কথা। সে শুনেছিল ঈদগাহ্ ময়দানের জায়গাটা ভালো না। সেখানে একটা হুজুর থাকে। যে রাতের বেলা বের হয় আর কাওকে একা পেলে ঘাড় মটকে মেরে ফেলে । 


সিকন এগুলোতে বিশ্বাস করে না। কিন্তু কাকতালীয় ভাবে সে একটা ঈদগাহ্ ময়দানের পাশেই বসে আছে আর তার সামনে যে লোকটা আছে রাস্তার অন্য পাশে সে হুজুরদের মতো দেখতে। আর আশেপাশের পরিবেশটা এতোই নিরব যে তাকে ভূতে বিশ্বাস করতে বাধ্য করছে। রাস্তা দিয়ে যাওয়া লোকটা হঠাৎ থামলো। এতে সিকনের ভয় আরো বেড়ে গেলো ..কিন্তু শেষ পর্যন্ত তেমন কিছুই হলো না। লোকটা সিকনকে দেখলোও না। সোজা হেটে চলে গেলো। শুধু শুধু ভয় পেলো সিকন।।


শব্দ হচ্ছে..!! কিসের শব্দ উপলব্ধি করার আগেই গার্মেন্সের বাস চলে এলো। বাস ভর্তি গার্মেন্স-কর্মী। প্রায় সবই মধ্য বয়সী নারী। আবার কেউ কেউ কিশোরী। সিকন এক দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। সিকনের মনে কোনো চিন্তা নেই এখন। কে বেশি সুন্দর কার মুখে মায়া মায়া ভাব বেশি এগুলোর কিছুই তার মনে এখন জায়গা নিচ্ছে না । সে শুধুই তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। দেখতে দেখতে বাস চলে গেলো। 

 

এবার একটু নরেচরে বসে ভাবতে লাগলো সে। 

কেমন আজব জীবন। সকালে সেই চলে যাও আর রাতে ফিরে এসে খাবার খেয়ে ঘুমাও। ব্যাস এতটুকুই..!!

সিকন এটা ভেবে কতক্ষন পার করেছে সে জানে না। সে হঠাৎ চমকে উঠলো আর ঘড়ির দিকে তাকালো । ঘড়িতে এখন পৌনে বারোটা বাজে। সামনে একজন মধ্য বয়সী লোক দাড়িয়ে একটা ঠিকানা জিজ্ঞাসা করছে। সিকন লেকটাকে খেয়ালই করেনি। খেয়াল করলে হয়তো তখন ঘড়ির দিকে তাকাতো না । সে লোকটা আবারও জিজ্ঞাসা করলো…
 

    - শিমুলীয়া বাজারটা কোন দিকে ?

সিকন এবার তার কথা শুনলো আর একটু ভেবে ভললো..
 

    - শিমুলীয়া বাজার তো এখান থেকে অনেক দূর। 

    - আচ্ছা, কোন দিকে?

    - এই দিক দিয়ে চলে যান সামনে মোড় আসবে সেখান থেকে ডান দিকে যাবেন। 

    - আচ্ছা ধন্যবাদ। আসসালামুয়ালইকুম। 
 

বলে লোকটা চলে গেলো। সিকন সালামের উত্তর দিলো লোকটা চলে যাওয়ার পর। সালাম দেওয়ার অভ্যেস সিকনের আছে কিন্তু কেউ সালাম দিলে তার উত্তর দিতে সিকনের বেশ ভাবতে হয়। শীত শুরুর দিকে হলেও এখন বেশ ঠান্ডা বাতাস বইছে। গলা থেকে মাফলার হাতে নিয়ে কানের দিকটা ভালো করে ঢেকে নিলো সিকন । 


কুকুরের কান্নার শব্দে সিকনের ঘুম  ভাঙলো। দোকানের বেঞ্চিতে এতোক্ষন সে ঘুমিয়ে ছিলো সে। অল্প ঠান্ডায় বেশ গভীর ঘুমে আচ্ছন্য ছিলো সে। কুকুরের এমন দুঃখ মিশ্রিত কান্না যদি কানে না আসতো । তাহলে বোধহয় ভোরেই জাগতো সিকন। কিন্তু ঘুম ভেঙেছে, এখন আর ঘুম আসবেনা তার। বাকি রাত জেগে কাটাতে হবে। ঘড়ির দিকে সে তাকালো.. খুব বেশি সময় অতিবাহিত হয়নি। ঘড়িতে এখন ১টা বেজে ২০ মিনিট। কুকুরগুলোও এখন বেশ শান্ত হয়ে শুয়ে আছে। সিকন মনে মনে ভাবছে.. রাত্রি বেলা কি এমন হয় কুকুরের, যে তারা দল বেধে কাদেঁ । আর এমন ভাবে কাদেঁ যে মনের মধ্যে বড় ধরনের ভয় জেগে উঠে। 



পাখির কলরব শোনা যাচ্ছে। ভোর হতে এখনো ঢের দেড়ি। তবুও পাখির কলরব শোনা যাচ্ছে। আশেপাশের পরিবেশ এমন হয়েছে যেনো ভোর হতে দেড়ি নেই । তবে ঘড়িটা দেখলে সঠিক সময়ের আভাস পাওয়া যায়। কোন কোন পাখি কলরব করছে এখন? নিজেকেই প্রশ্ন করছে সিকন আবার মনের মধ্যে নিজে থেকেই উত্তর দিচ্ছে। খুব বেশি পাখির নাম সে জানে না। চোখের সামনে দেখা পরিচিত পাখির নাম ভাবছে সে। শালিক ডাকছে হয়তো । তা না হলে ঘুঘু হবে। কাক হবে না ..কাকের ডাক আরো জোড়ালো হতো। ময়না কিংবা টিয়াও হবে না।  


শেষ রাতের দিকে আকাশে একটু কালো মেঘ জমেছে। সিকন এটা লক্ষ্যই করতো না যদি আকাশ ফুরে চাদেঁর আলো না আসতো । খুব বেশি আলো আসছেও না । পূর্ণিমা টলে গেছে হয়তো তিন-চারদিন আগে। তবে কালো মেঘের জন্যে ফালি হওয়া চাঁদটাকেও সুন্দর দেখাচ্ছে। সিকন চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে আর আনমনে ভাবছে । কোনো বিশেষ মানুষের কথাই ভাবছে সে। চাঁদের সাথে প্রেমের সম্পর্ক বোধহয় সৃষ্টির শুরু থেকেই । অনেক কবিই চাঁদ সম্পর্কে লিখেছেন। চাঁদের সুন্দর্য নিয়ে লিখেছেন। লিখেছেন তাদের প্রেমিক/প্রেমিকা সম্পর্কে। হয়তো চাঁদকে দেখেই ভালোবাসার মানুষের কাথা মনে পরে। সিকনেরও হয়তো মনে পরেছে তার ভালোবাসার মানুষের কথা।যে বিশেষ মানুষের কথা সে ভাবছে সে হয়তো ভালোবাসার মানুষ। 

পূর্ব দিক থেকে সূর্যের হালকা আলো আসছে। চাঁদটা এখনো পশ্চিম আকাশে মিশে যায়নি। ইতিমধ্যে আশেপাশে লোকের আনাগোনা লক্ষ্য করলো সিকন। ভোর হচ্ছে.. আশে পাশের কৃষকরা তাদের শীতকালীন সবজি বাজারের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। সিকনের আরো একটারাত অতিবাহিত হলো রাস্তার পাশে। সে জানে না আর কতরাত এমন রাস্তার পাশে বেঞ্চিতে শুয়ে বসে কাটাতে হবে। সে জানে না তার ভবঘোরে পরিস্থিতি কবে শেষ হবে। কবে পৌছাঁবে তার গন্তব্যে । আরো একটা দিন শুরুর সাথে সাথে আরো একটা রাতের অপেক্ষা শুরু তার …….

ভয়


 ছোট বেলার থেকেই আমি ছিলাম একটু দুর্বল হৃদয়ের মানুষ কিন্তু আমি ভুতের গল্প  শুনতে অনেক ভালো-বাসতাম  ।  মজার ব্যাপার হলো যে আমার সাথেও একটা ঘটনা ঘটে ।  ঘটনাটা  ঘটে আমি যখন  আলাদা একটা ঘরে পড়তে বসতাম তখন ।  আমি যখন পড়তে বসতাম তখন আমার মনে হতো যে কে যেনো আমার পিছনে রয়েছে । পিছনে তাকালে কাউকে দেখতাম না ।  পিছনে কাউকে না দেখতে পাওয়ায় আমি আবার পড়তে শুরু করতাম ।  এই ব্যপারটা আমি প্রাই  প্রতিরাতেই লক্ষ করতাম ।  কিন্তু একদিন  ব্যপারটা অন্যরকম ঘটলো । প্রতিরাতের  মতো আমি সেরাতেও পড়তে বসেছিলাম ।  তখন আমার মনে হলো  কেযেনো আমার ঠিক পিছনে বসে আছে আর সেযেনো  আমাকেই দেখছে। আমি পিছনে তাকাতেই দেখলাম একটা মানুষ যার শরীর ভরা লোম এবং  তার  মাথার নিচের দিকটা উলটো । আমি তাকে দেখে একটুও ভয় পাইনি ।  তার পর আমার চোখ তার  চোখের মধ্যে পরলো তখন আমি দেখলাম তার চোখের মনির সব টুকু আংশ কালো। একদম  টিকটিকির চোখের মনির মতো ।  এই দৃশ্য দেখে আমার শরীরের সব লোম দারিয়ে গেলো  এবং  আমার হাত পা একদম ঠান্ডা হয়ে গেলো  ।  এরকম অবস্থায় আমি চেস্টা  করছিলাম ঘর থেকে বের হতে কিন্তু আমার শরীরর যেন একটুও নরছে না।  অনেক চেস্টা করলাম কিন্তু ঘর থেকে বের হতে পারলাম না ।  একটু পর দরজার পেছন থেকে শব্দ এলো  '' এই  খেয়ে-যা অনেক রাত হয়েছেতো "। সেই  ডাকটা ছিল  আমার মায়ের ।  আমি মাকে বললাম তুমি যাউ আমি আসতেছি । তার পর আমি হাত-মুখ ধুয়ে  এসে অনেক খুজলাম কিন্তু সেই লোকটিকে আরপেলাম না ।  এর পর আমি আর কখনো সেই লোকটির দেখা পাইনি ।  এরপর থেকে আমি যখন একা পরতে বসতাম তখন মনে হতো কেযেনো আমার পেছনে দাঁড়িয়ে  আমার পড়া দেখছে।  কিন্তু আমি পিছনে তাকালেই একটা ঠান্ডা বাতাস আমার গা স্পর্শ করে ঘর থেকে বের হয়ে যায়।  এবং  আমাকে কিছু একটা বলতে চায়  কিন্তু বলতে পারেনা ।

আপনিও যখন পড়তে বসেন তখন হইতো আপনার পেছনেও কেউ থাকে হইতোবা সে আপনাকেই দেখে  ..

আমি চঞ্চলা

 



:::: 

গল্প পড়ার শখ আমার অনেক দিনের আর এই শখে পরেই এক দাদু বাড়িতে গিয়েছিলাম ঘুরতে।  সে দাদুর নিজস্ব একটা পাঠাগার আছে।   আর তার সবমিলিয়ে প্রায় দুই হাজারের উপর গল্পের বই, ডাইরি, খাতা আছে।  তার মধ্যে একটি বেশ পুরানো খাতা তিনি আমাকে দেন পড়তে।  আর আজকের গল্পটা সেই খাতা থেকেই নেওয়া । তাহলে গল্পটা শুরু করা যাক।  

    

      অক্টোবর মাস চলছে বার ও তারিখ কিছুই জানিনা।  কিছুক্ষণ  আগেই চোখ খুলেছে।  হয়তো মাথায় ভিষণ আঘাত লেগেছিলো।  চোখ খুলেই দেখলাম বালির উপর পরে আছি আর পাশে একটা ব্যাগ ।  অবশ্য অন্য কারোর ব্যাগ না,  আমার নিজের ব্যাগই। ব্যাগে আমি আহামরি কিছু রাখিনি, রেখেছি শুধু  একটা খাতা, কয়েকটা কলম আর কিছু টাকা।  খাতা রাখার কারন আমি মাঝে মাঝে একটু লেখা লেখি করি।  কোনো খবরের কাগজে বা বইয়ের জন্যে নয়।  যেমন এখন লিখছি, ঠিক এইরকম।  এমনিতে দুই- তিন লাইন করে লিখি কিন্তু এখন একটু বেশিই লিখছি । আশেপাশে কেউ নেই তো তাই।

 


 

::২:: 

   মাথার ব্যাথাটা কমেছে।  আর আমার কাছে এখন পরিষ্কার আমি এখানে কিভাবে এলাম। গত মাসে আমি সমুদ্র ভ্রমনে বের হয়েছিলাম।  এ কথাটা গুছিয়ে সুন্দর করে বললাম।  যদি সত্যিটা বলি তাহলে দাড়ায় আমি আমার দেশ ছেড়ে পালাচ্ছিলাম।  একদম যে সব ঠিকঠাক করে,  তা কিন্তু নয়।  এমনি হুট করে।  হাতের কাছে ব্যাগ ছিলো আর হাজার তিনেক টাকা।  দেশ ছেড়ে অন্য দেশে গেলেই ভালো ভাবে থাকতে পারবো ভেবেই বের হয়েছিলাম।  আর সমুদ্রের কাছে এসে একটা মাঝিকে পাঁচশ টাকা দিয়ে রাজি করিয়েছিলাম যেকোনো একটা কার্গো শিপে যেনো আমাকে তুলে দেয়।  যেই ভাবা সেই কাজ।  সবার চোখে ফাকি দিয়ে মাঝি আমাকে একটা বড় শিপে তুলে দিলো। তাও আবার শিপের একটা কেবিনে যেখানে শিপের লোক আসে না বললেই চলে।  কিন্তু দেখুন আমি এখন এই দ্বীপের মধ্যে আটকে পরলাম।  এই দ্বীপে এসে পৌঁছানো কম রোমাঞ্চকর ছিলো না,  যেনো কোনো ইংরেজি সিনেমা।  

মাঝি তো আমাকে রেখেই উধাও হলো। এরপর আমি কেবিনটাতে ভালো ভাবে গুছিয়ে বসলাম। জাহাজ চলতে শুরু করল, জাহাজের ক্রমাগত দুলুনি আমার শরীরের বারটা বাজাচ্ছিলো।  আর তখন কেবিনের দরজার সামনে কারো অস্তিত্ব লক্ষ্য করলাম।  এক জন নয়,  দুজন। দুজনে মিলে কেবিনটা খুলতে চেষ্টা করছে।  আর কিছু ভেবে ওঠার আগেই কেবিনের দরজা খুলে গেলো।  আমি দরজার সাথে পিঠ লাগিয়ে ছিলাম বলে তাদের সামনে হুমরি খেয়ে পরলাম।  তারা দুজন-ই আমাকে দেখে এবং কিছুটা বিস্মিত হয়ে একটু সরে দাঁড়ায়।  আমি তখনি উঠে দাঁড়াই এবং ভাবতে থাকি এখন কি করবো..?  তাদের সাথে কথা বলবো ? না, দৌড়ে পালাবো?  এর মধ্যেই একজন আমাকে ধরে ফেলে এবং আরেকজন জাহাজের আরো ভেতরে চলে যায়। যে ব্যক্তি আমাকে ধরে ছিলো সে অনেক শক্ত করে ধরেছিলো তাই আমি তার হাত থেকে ছুটে দৌরে পালাতে চেষ্টা করি।  জাহাজের ছাদে পৌঁছে যাই এবং সেখান থেকে একটা লাইফ জ্যাকেট নিয়ে সমুদ্রের মধ্যে ঝাপ দিয়েছি, তখনি জাহাজের রেলিংএ মাথাটা সজোরে লাগে আর আমি সমুদ্রে পরি।   এরপর যখন চোখ খুলে তখন দেখি আমি এখানে পরে আছি। যাই এখন একটু আশেপাশে দেখি কি আছে এখানে।

 


 

::৩::

অচেনা জায়গাতে যদি হঠাৎ চোখ খুলে যায় তাহলে আশে-পাশের প্রকৃতি বুঝতে অনেক সময় লাগে। এইতো আমি যখন বালির উপর পরেছিলাম তখন ভেবেছিলাম সকাল হয়েছে।  কিন্তু এখন দিগন্তে সূর্যের মিলিয়ে যাওয়া দেখে মনে হচ্ছে সন্ধ্যা।  আমি অনেকটা সময় পার করেছি এই দ্বীপটাতে।  অনেকটা সময় বললাম কারন আমার চোখ খোলার পর আমি যে আশেপাশে ঘুরছিলাম তখনি দেখি লতা আর বাঁশ দিয়ে তৈরি একটা ঘর আর ঘরের মধ্যে আমার সবচেয়ে পছন্দের কলটা আর আমার খাতা কয়েকটা পৃষ্ঠা ।  কয়েকটা বলতে ছয়টা পৃষ্ঠা তার মধ্যে দুইটা পৃষ্ঠা একদমি খালি আর বাকি চারটার দুটোর লেখা বোঝা যায় না ঠিক মতো এবং বাকি দুটোতে আমি অনেক আগে লিখেছিলাম যা আমার স্পষ্ট মনে আছে।  আর এতেই পরিষ্কার আমি এই দ্বীপে আজ আসিনি । বাঁশের ঘরটার পাশে একটা কলা গাছ আছে আর তাতে পাকা পাকা কলাও আছে।  হয়তো কেউ আসে না এখানে,  তাই কলাগুলো গাছেই পেকেছে।  এতো ভেবে কি লাভ?  আজ রাতে কলা দিয়েই কাজ চালিয়ে নিতে পারবো ।  

 


 

::৪::

এটা যদি খাতা না হয়ে ডাইরি হতো তাহলে অবশ্যই এখন আমি বুঝতে পারতাম আজ কত তারিখ এবং কি বার।  একটু আগেই কলা খেয়েছি।  ভেবেছিলাম অনেকগুলো কলা খেতে পারবো কিন্তু না।  মাত্র  চারটা কলাই খেতে পেরেছি ।  মাথার উপর এখন চাঁদ রয়েছে।  আমি বাঁশের ঘরটা থেকে কিছুটা দূরে বসে আছি।  জোছনার আলোয় সব দেখা যাচ্ছে।  যে খাতাটায় লিখছি সেটা এবং অনেক দূরে থাকা বড় পাথরটা দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট।  অবশ্য বাঁশের ঘরটা থেকে কিছু দূরে একটা কিছু মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছে আবার হঠাৎ করে উধাও হয়ে যাচ্ছে ।  হীরের মতো চকচক করছে,  হীরে হতেই পারে।  অবশ্য উঠে গিয়ে দেখে আসলেই হয়।  যাই গিয়ে দেখেই আসি।  

 

 

::৫::

যেটা দেখতে গিয়েছিলাম সেটা দেখে তো মন ভরেই গেছে সাথে একটা বাক্সও পেয়ে গেছি।  হীরের মতো যেটা চকচক করছিলো সেটা আসলে শিশির কণা। গাছের পাতার প্রান্তে জমা হতো এবং যে বাক্সটা পেয়েছি সেটার উপরে লাগানো আয়না থেকে চাঁদের আলো প্রতিফলিত হয়ে শিশির কণায় আসতো।  আর এতেই একটা বড় বিভ্রমের তৈরি করেছিলো।  অবশ্য দেখতে গিয়ে লাভি হয়েছে । সখও মিটলো আর একটা বাক্সও পেলাম।  একেই বোধয় বলে "রথ দেখাও হলো, কলা বিক্রিও হলো "।  বাক্সটা দেখতে ততটা আহামরি নয়।  কাঠের বাক্স, ঢাকনার দিকে উপরে এক খন্ড আয়না লাগানো।  বাক্সের সামনে কিছু লেখা আছে যেগুলো মুছে গেছে বলাই যায়।  বাক্সটা না খুলে থাকতে পারছি না।  

 


 

::৬::

বাক্সটা খোলার পর প্রথমেই চোখে পড়লো আমার চির-পরিচিত কৃষ্ণচূড়া ফুল।  শুকনো বলে ফুলটা দেখে একটু কেমন জেনো লেগেছিলো।  এরপর যেটা পেলাম বাক্সটার মধ্যে তা হলো একটা ১৯৩১ সালের চামড়ায়  মোড়ানো  ডাইরি।  ডাইরির সাথে একটা সুন্দর ঝর্ণা কলমও ছিলো।  অবশ্য সেটার কালি শুকিয়ে গেছে। বাক্সটার মধ্যে একটা ছোট সিগারেটের বাক্সও ছিলো এবং তাতে এক বাক্স দেশলাই আর একটা আধ খাওয়া সিগারেট। আর পুড়ানো ধাচের একটা রিভালভার, যেটা একদমি নষ্ট।  বাক্সটা যার ছিলো সে খুব সৌখিন লোক হবেন হয়তো।  

 

 

::৭::

মনের সাথে অনেক্ষন যুদ্ধ করার পর বাক্সে পাওয়া সেই ডাইরিটা পড়েই ফেললাম। পড়ার পর বুঝলাম ডাইরিতে সুধু একটা মেয়েকে নিয়েই লেখা হয়েছে।  ডাইরির লেখক যেভাবে লিখেছে সে ভাবে উল্লেখ করছি "   মানুষ সব সময় বেশি বেশি চায়।  কিছুতেই মন ভরে না।  যেমন আমি, এত সুন্দর চাঁদের আলোর মধ্যে বসে আছি কিন্তু তবুও মনে হচ্ছে যদি আশেপাশের পরিবেশটা আরো একটু সুন্দর হতো।  আমার পাশে এখন চঞ্চলা বসে আছে।  সমুদ্রের থেকে মাঝে মাঝে আসা দমকা বাতাসে তার চুল দোলছে।   চঞ্চলার চুল সহজে বাতাসে দোলখায় না।  বাতাসে দোলার মতো  তার চুল নয়।  তার চুল অনেক বড়বড় এবং অনেক ঘনও বটে।  বিনুনি করলে অনেক মোটা বিনুনি হয়।  

 


 

সে পাশে বসে থাকলেও আমার সাথে কথা বলছে না।  একটু আগে সামান্য কথা নিয়ে ঝগড়া হয়েছে আমাদের।  চঞ্চলার সাথে আমার গতকাল  রাতেই প্রথম দেখা হয়েছে আর এর মধ্যেই আমরা কত ঘনিষ্ঠ হয়ে গেছি।  তার আসাটা ছিলো একটা স্বপ্নের মতো।  চাঁদের আলোয় এক নারী যেনো আবেগ-ভরা চোখে আমার দিকে আসছে  ।  অচেনা হলেও যেনো মনে হচ্ছে অনেক দিনের চেনা।  তার ঘন কালো চুল কোমর পেরিয়ে যেনো মাটি ছুঁচ্ছে।  সাথে মাথায় থাকা ডানদিকে একটু হেলানো কৃষ্ণচূড়া ফুলের চূড়া,  একেবারে যেনো অপূর্ব একটা দৃশ্য তৈরি করেছিলো।  সে আমার সামনে এসেই প্রথমেই বললো 'এই যে,আমি চঞ্চলা ।  আপনার সাথে দেখা হয়ে ভালো লাগলো ' ।  চোখ ভরা বিস্ময় আমি আমার নাম বললাম।  আমিতো প্রথমে ভেবেছিলাম এটা আমার কল্পনা।  তা ভাবারো যুক্তি যুক্ত কারন আমার কাছে আছে।  দশ বারো দিনে কারো দেখা পাইনি  আজ হঠাৎ করে এই সুন্দিরী রমনির সাথে দেখা।  সুধু দেখা যে তাও নয় কথোপকথন।  সে গতকাল থেকেই আমার সাথে আছে।  কথায় কথায় একবার বলেছিলো তার কিছু ছেলে লাগবে।  আমি তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম আমাকে দিয়ে হবে কিনা।  সে এর উত্তরে আমাকে বলল শুধু তোমাকে দিয়ে হবে না।  

 

 

চঞ্চলা কখন যে পাশ থেকে উঠে গেছে খেয়ালি করিনি।  এখন খেয়াল করলাম যখন তার হাতে থাকা বড় তরবারিটার থেকে আলো এসে আমার চোখে পড়লো।  আচ্ছা তার হাতে বড় তরবারি কেনো?  এখানে আসলে জিজ্ঞাসা করতে হবে।  তার হাতের তরবারি সাথে মাথায় থাকা কৃষ্ণচূড়া ফুলের চূড়োটা সুন্দর মানিয়েছে।  "   এই পর্যন্তই ডাইরিটাতে লেখা।  শেষ পর্যন্ত জানার অনেক আগ্রহ হয়েছে কিন্তু কি করার ডাইরির বাকি পৃষ্ঠাগুলো খালি।  যাই অনেক রাত হয়েছে ঘুমোতে হবে।  

 


 

 

::৮::

 

   সূর্যাস্ত দেখছি আর সারাদিনের কথা ভাবছি।  বিশেষ করে দুপুরে ভয় পাওয়ার ব্যাপারটা।   অন্ধকার নামার সাথে সাথে মানুষের ভয় বেড়ে যায় কিন্তু আমার বেলায় এর উল্টো হচ্ছে ক্রমেই দুপুরে পাওয়া ভয় দূরে চলে যাচ্ছে।দুপুরে একটু ভয় পেয়ে ছিলাম।  ভয় পাওয়াটা স্বাভাবিক।  আজ দুপুরে যখন ঘুরতে বের হয়েছিলাম তখন আমি অনেক গুলো বাক্স দেখতে পাই এবং সেগুলোর ভিতর কি আছে সেটা দেখতে যাই। প্রতিটা বাক্সের মধ্যেই আমি আলাদা আলাদা মানুষের ব্যবহৃত বস্তু দেখি।  যেনো জায়গাটা একটা কবরস্থান।  কিছু কিছু বাক্স অনেক পুড়াতন আবার কোনটা প্রায় নতুন।  বাক্স দেখতে দেখতে একটা গর্তে পরে যাই যেটাতে কয়েক হাজার এরকম বাক্স আছে।  এতগুলো বাক্স একসাথে দেখে কিছুটা ঘাবড়ে যাই এবং গর্ত থেকে দ্রুত বের হয়ে আসি। সারাদিন এটা নিয়ে ভেবেছি।  

চাঁদটা আজকে একটু বেশিই বড় দেখাচ্ছে।  জোছনায় পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে সমুদ্র তীর বরাবর কে যেনো হাটছে। হেটে হেটে এদিকেই আসছে।  দেখেতো  কোনো মেয়ে বলে মনে হচ্ছে। মাথায় ঘন কালো চুলে একটি চূড়ো পড়া।  দেখতে দেখতে আমার কাছেই চলে এসেছে। 

 

খাতাটাতে এতটুকুই লেখা আছে।  হয়তো এর পরে এমন হয়েছে।  

 

“কিছু বুঝে উঠার আগেই সে বলে উঠলো

      এই যে, আমি চঞ্চলা।  আপনাকে এখানে দেখে ভালো লাগলো ।।”

মাতৃত্বের স্বাদ

  “হ্যালো! মিস বিশ্বাস?”  অচেনা স্বর, কিন্তু বাঙালি উচ্চারণ। “ইয়েস, ’অ্যাম ডক্টর বিসওয়াস। হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ?” কোভিড-এর কড়া লকডাউন আলগা হ...